একদা দেশে জীবিকার খোঁজে দূর থেকে ছুটে আসা মানুষেরা দেশীদের ঝাঁকে মিশে পদ্মার তীরের মহাকাল গড়ে যে বসতি গড়েছিল তা থেকেই বতর্মান রাজশাহী মহানগরীর উৎপত্তি।
আয়তন : ২৪-০৫', ২৫-১৪' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮-০১' হতে ৮৯-২৫' পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত।
আয়তন : (রাসিক এলাকা) = ৯৬.৭২ বর্গ কিলোমিটার।
সীমানা : প্রমত্তা পদ্মার উত্তর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রাজশাহী মহনগরীর চতুপার্শ বেড়া দিয়ে আছে রাজশাহী জেলার পবা থানা। উত্তরে: মৌজা হড়গ্রাম জে এল নং ৪৩, মৌজা সড়কগ্রাম জে এল নং ১০৯, মৌজা মেহেরচন্ডি জে এল নং ১২০।
দক্ষিণে: পদ্মা নদী । পূর্বে : মৌজা বুধপাড়া জে এল নং ১২৫, মৌজা মিজার্পুর জে এল নং ১১৯, মৌজা ডাঁশমারী জে এল নং ১৯৪। পশ্চিমে : মৌজা গোয়ালপাড়া জে এল নং ৪২, মৌজা হাড়ুপুর (আংশিক) জে এল নং ২১৬।
জলবায়ু : বাংলাদেশের অবস্থান ক্রান্তীয় অঞ্চলে বলে এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ।
মহানগরের গড় তাপমাত্রা = ২৩.৮৩ সে :(১৯৯১-১৯৯৬)
মহানগরের বাষির্ক বৃষ্টিপাত = ১৪৪৭.৬মি.মি.(১৯৯৬-২০০১)
বাষির্ক গড় আদ্রতা = ৭৬% (২০০১)
থানা : ৪ টি ১। বোয়ালিয়া ২। রাজপাড়া ৩। শাহ্ মখদুম ও ৪। মতিহার
ওয়ার্ড সংখ্যা : ৩০ টি
মহল্লা : ১৩৪ টি
জনসংখ্যা
৩,৮৮,৮১১ জন ( আদম শুমারী ২০০১)
পুরুষ
২,০৮৫২৫ জন
মহিলা
১,৮০,২৮৫ জন
সেক্স রেসিও
১১২.৩
রাজশাহী সিটি কপোরেশন এলাকার থানা ও ওয়ার্ড ভিত্তিক মহল্লাসমূহ
ওয়ার্ড নং
থানার নাম
মহল্লার নাম
১
রাজপাড়া
১. কাশিয়াডাঙ্গা (কাঠালবাড়ীয়া)
২. শাহাজিপাড়া
৩. রায়পাড়া
৪. আদুবুড়ি
৫. শুড়িপাড়া
৬. সায়েরগাছা
৭. হাড়গ্রাম (মুন্সিপাড়া)
৮. হাড়ুপুর (সিটি কপোরেশনের আওতাভুক্ত অংশ)
২
ঐ
৯. হড়গ্রাম নতুনপাড়া
১০. হড়গ্রাম নতুনপাড়া
১১. হড়গ্রাম রাণীদিঘি
১২. হড়গ্রাম কলোনী
১৩. হড়গ্রাম বিদ্দিরপাড়া
১৪. নগরপাড়া
১৫. মোল্লাপাড়া
১৬. শেখপাড়া
৩
ঐ
১৭. দশপুকুর
১৮. বহরমপুর
১৯. নতুন বিলসিমলা
২০. লক্ষীপুর (ডিংগাডোবা, রেল লাইনের উত্তর অংশ)
৪
ঐ
২১. হড়গ্রাম বাজার ( পদ্মকামিনী রাস্তার দক্ষিণ ও পূব অংশ)
২২. বুলনপুর
২৩. গোয়ালপাড়া
২৪. কেশবপুর
২৫. নবাবগঞ্জ
৫
ঐ
২৬. রাজপাড়া
২৭. মহিষবাথান
২৮. কুলুপাড়া
২৯. ভাটাপাড়া ( হেলেনাবাদ কলোনীসহ)
৬
ঐ
৩০. লক্ষীপুর (অংশ) এবং বহরমপুর (রেলওয়ে লাইনের দক্ষিণ অংশ)। (উত্তরে রেলওয়ে লাইন, দক্ষিণে-লক্ষীপুর রাস্তা, পূর্বে মেডিক্যাল ক্যাম্পাসের পশ্চিম বাউন্ডারী, পশ্চিমে লক্ষীপুর ঝিল)
৭
ঐ
৩১. চন্ডিপুর
৩২. লক্ষীপুর ভাটাপাড়ার পূব ও চন্ডীপুরের উত্তর অংশ
৩৩. শ্রীরামপুর
৩৪. বেতিয়াপাড়া
৮
বোয়ালিয়া(প্রকৃতপক্ষে ৮ নং ওয়ার্ড বোয়ালিয়া-রাজপাড় থানার অন্তভূর্ক্ত )
৩৫. কাজীহাটা
৩৬. সিপাইপাড়া
৯
ঐ
৩৭. হোসনীগঞ্জ
৩৮. শেখপাড়া
৩৯. দরগাপাড়া
৪০. জোতমহেশ
৪১. শেরুসারপাড়া
১০
বোয়ালিয়ার (অংশ) ও রাজপাড়া (অংশ)
৪২. হেতমখাঁ
৪৩. পুরাতন বিলসিমলা৪৪. গোয়ালপাড়া
৪৫. ওয়াপদা কলোনী (কলাবাগান)
৪৬. মেডিক্যাল ক্যাম্পাস
১১
বোয়ালিয়া
৪৭. হেতমখাঁ সজিপাড়া
৪৮. হেতমখাঁ (পানবহর)
৪৯. মালোপাড়া (পশ্চিম অংশ)
৫০. রাজারহাতা
৫১. কাদিরগঞ্জ (গোরস্থানের পশ্চিম অংশ)
৫২. মেথরপাড়া
৫৩. কারিকরপাড়া
৫৪. শাহাজিপাড়া
১২
ঐ
৫৫. ফদকীপাড়া
৫৬. কুমারপাড়া
৫৭. সাহেব গঞ্জ
৫৮. সাহেব বাজার
৫৯. রাণী বাজার
৬০. মালোপাড়া (পূব অংশ)
৬১. গণকপাড়া
৬২. মিয়াপাড়া
১৩
ঐ
৬৩. কাদিরগঞ্জ (গৌরহাংগা ও ষষ্টিতলা)
৬৪. দড়িখরবোরা (রেলওয়ে লাইনের দক্ষিণাংশ)
১৪
বোয়ালিয়া ( অংশ) ও রাজপাড়া অংশ
৬৫. উপশহর
৬৬. তেরখাদিয়া
১৫
বোয়ালিয়া
৬৭. সাপুরা (গোরস্থান পাড়া, সাহাজীপাড়া, পলিটেকনিক, সেচ বিভাগ, শালবাগান)
৬৮. কাদিরগঞ্জ দড়িখরবোনা
৬৯. দড়িখরবোনা (রেলওয়ে লাইনের উত্তরাংশ)
১৬
ঐ
৭০. সপুরা শিল্প এলাকা (সেনানিবাসসহ)৭১. জিন্নানগর
৭২. মথুরডাংগা
৭৩. বখতিয়ারাবাদ
৭৪. কয়েরদাঁড়া
১৭
শাহ মখদুম
৭৫. বড়গ্রাম
৭৬. নওদাপাড়া (জনসংখ্যার প্রতিবেদন ৯১ অনুসারে ১৭ নং ওয়ার্ডে প্রকাশিত সকল এলাকা অন্তভূর্ক্ত)
১৮
বোয়ালিয়া অংশ ও শাহ মখদুম অংশ
৭৭. আসাম কলোনী
৭৮. পবা
৭৯. পবা রাইস মিল
৮০. আহম্মদ নগর
৮১. ফিরোজাবাদ
৮২. পবা নতুন পাড়
৮৩. পবা, টিটিসি
৮৪. পবা মঠপুকুর
৮৫. শালবাগান (বন অফিসের দক্ষিণ রাস্তার উত্তরাংশ)
১৯
বোয়ালিয়া
৮৬. শিরোইল কলোনী
৮৭. ছোট বনগ্রাম কলোনী
৮৮. ছোট বনগ্রাম
৮৯. হাজারাপুকুর
৯০. রেলওয়ে কলোনী
২০
ঐ
৯১. বোয়ালিয়া পাড়া
৯২. সুলতানাবাদ
২১
ঐ
৯৩. বল্লবগঞ্জ
৯৪. শিরোইল
২২
ঐ
৯৫. সাগরপাড়া
৯৬. রামপুর বাজার
৯৭. খানসামার চক
৯৮. ঘোড়ামারা (কুমারপাড়াসহ স্টীমারঘাট রোডের পূব অংশ)
২৩
ঐ
৯৯. সেখেরচক
১০০. রামচন্দ্র পুর (পশ্চিমাংশ)
২৪
ঐ
১০১. বাজে কাজলা (পশ্চিমাংশ)
১০২. রামচন্দ্র পুর (পূবাংশ আহম্মদপুরসহ)
২৫
ঐ
১০৩. তালাইমারী (পশ্চিমাংশ)
১০৪. রাণী নগর (দক্ষিণ অংশ)
২৬
ঐ
১০৫. মেহেরচন্ডী
১০৬. নামোভদ্রা
১০৭. চকপাড় মেহেরচন্ডী
২৭
মতিহার অংশ ও বোয়ালিয়া অংশ
১০৮. প্রবৌশল মহাবিদ্যালয় (বি.আই.টি)
১০৯. টিকাপাড়া
১১০. মিরের চক
১১১. রাণীনগর (উত্তর অংশ)
১১২. দেবীশিংপাড়া
১১৩. বালিয়াপুকুর
১১৪. শিরইল মঠপুকুর
১১৫. উপর ভদ্রা
২৮
মতিহার
১১৬. কাজলা
১১৭. ধরমপুর
১১৮. তালাইমারী (পূবঅংশ)
১১৯. বাজে কাজলা (পূবঅংশ)
১২০. চরকাজলা
২৯
ঐ
১২১. সাহতবাড়িয়া
১২২. খোজাপুর
১২৩. ডাশমারী
১২৪.চর সাতবাড়ীয়া
১২৫.শ্যামপুর ডাশমারী
৩০
ঐ
১২৬. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
১২৭.মির্জাপুর
১২৮. মাসকাটা দিঘী (মেহেরচন্ডী)
১২৯. বুধপাড়া
১৩০. মোহনপুর
১৩১. ফল বাগান
১৩২.কৃষি ফার্ম
১৩৩. বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার
১৩৪. মেহেরচন্ডী বধুপাড়া
সংক্ষেপে রাজশাহী জেলা পরিচিতি
আয়তন ২৪০৭.০১ বর্গ কিলোমিটার।
জনসংখ্যা ২২,৭৪৩৪০ জন (২০০১ সালের আদমশুমারী)।
পুরুষ ১১,৮১,০০০জন, নারী ১০,৯৩,৩৪০ জন।
শিক্ষার হার: ৪৭.৪৩ (২০০১ সালের আদমশুমারী)।
জেলা থানা: ১৩টি।
উপজেলা-৯টি, থানা-৪টি (আরএমপি)।
উপজেলা: পবা, গোদাগাড়ি, তানোর, মোহনপুর, বাগমারা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাঘা, চারঘাট।
থানা (আরএমপি): বোয়ালিয়া, রাজপাড়া, শাহমখদুম ও মতিহার।
জাতীয় সংসদের আসন: ৬ টি।
লক্ষীপুর, জেলা প্রশাসন,পুলিশ সুপার, জেলা পরিষদ অফিস রাজপাড়া থানার মহল্লায় অবস্থিত।
কারাগার ১টি।
রাজশাহীর নামকরণ
রাজশাহী নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফিরে যেতে হয়। এ শহরের প্রাচীন নামটি ছিল মহাকাল গড়। পরে রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে রাজশাহী নামটির উদ্ভব কিভাবে হলো এর সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা নাই । ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসেও রাজশাহী নামক কোন জনপদ বা স্থানের উল্লেখ নাই । অনেকে মনে করেন, এই জনপদ একদা বহু হিন্দু, মুসলিম, রাজা, সুলতান আর জমিদার শাসিত ছিল বলে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী। ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের (Bolch Mann) মতে, খ্রিষ্টীয় ১৫শ শতকে গৌড়ের মুসলিম সালতানাত এই জেলার ভাতুড়িয়ার জমিদার রাজা গণেশ কতৃর্ক আত্মসাতের সময় থেকে রাজশাহী নামের উদ্ভব হয়েছে। তিনি দাবী করেন, গৌড়ের সুলতান মাহমুদ শাহ বারবাক শাহ প্রভৃতির নামানুসারে যেমন রাজশাহীর আশে পাশে মাহমুদ শাহী, বারবাকশাহী পরগনার উদ্ভর হয়েছে। একইভাবে মুসলিম মসনদে আরোহণকারী হিন্দু রাজা শাহ বলে পরিগণিত হওয়াই এই এলাকার নামকরণ হয়েছে রাজশাহী। হিন্দু রাজ আর ফারসী শাহী এই শব্দ দুটির সমন্বয়ে উদ্ভব হয়েছে মিশ্রজাত শব্দটির। কিন্তু ব্লকম্যানের অভিমত গ্রহণে আপত্তি করে বেভারিজ (Beveridge) বলেন, নাম হিসেবে রাজশাহী অপেক্ষা প্রাচীন এবং এর অবস্থান ছিল রাজা গণেষের জমিদারী ভাতুড়িয়া পরগনা থেকে অনেক দূরে। রাজা গণেশের সময় এই নামটির উদ্ভব হলে তার উল্লেখ টোডরমল প্রণীত খাজনা আদায়ের তালিকায় অথবা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী নামক গ্রন্থে অবশ্যই পাওয়া যেত। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামই ইংরেজরা গ্রহণ করেন এই জেলার জন্য। এনেকে এসব ব্যাখাকে যথার্থ ইতিহাস মনে করেননা। তবে ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলার নবাবী আমল ১৭০০ হতে ১৭২৫ সালে নবাব মুশির্দকুলী খান সমগ্র বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩ (তের)টি চাকলায় বিভক্ত করেন। যার মধ্যে ‘চাকলা রাজশাহী' নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি এলাকা নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে প্রবাহিত পদ্মা বিধৌত ‘রাজশাহী চাকলা' কে তিনি উত্তরে বতর্মান রাজশাহী ও দক্ষিণে মুর্শিদাবাদের সঙ্গে অপর অংশ রাজশাহী নিজ চাকলা নামে অভিহিত করেন। প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু রাজ-জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি ছিলেন মুশিদ কুলির একান্ত প্রীতিভাজন ব্যক্তি। যে জন্য নবাব তাকে রাজা উপাধী প্রদান করেন। দক্ষিণ চাকলা রাজশাহী নামে বিস্তৃত এলাকা যা সমগ্র রাজশাহী ও পাবনার অংশ নিয়ে অবস্থিত ছিল, তা ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান নাটোরের রামজীবনের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করেন। এই জমিদারী পরে নাটোরের রাণী ভবানীর শাসনে আসে ও বহু অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। রামজীবন প্রথম নাটোর রাজ ১৭৩০ সালে মারা গেলে তার দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজা হন। ১৭৫১ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী ভবানী দেবী রাণী ভবানী নামে উত্তরাধীকারী লাভ করেন। অনেকের মতে, প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের উপর প্রীতি বশত এই চাকলার নাম রাজশাহী করেন নবাব মুশিদকুলী খান। কিন্তু ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাণী ভবানীর দেয়া নাম রাজশাহী । অবশ্য মিঃ গ্রান্ট লিখেছেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার বন্দোবস্তের কালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। নবাবী আমল থেকেই বৃহত্তর রাজশাহীর প্রশাসনিক কাযর্ক্রম পরিচালনা হতো নাটোর থেকে । নাটোর রাজ বৃহত্তর রাজশাহীর প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। বৃটিশ শাসনের পত্তন হলেও সে সূত্র ধরে নাটোরই প্রশাসনিক সদর ছিল। তখন রাজশাহী মহানগর তৎকালীন বোয়ালিয়া ছিল বিখ্যাত বাণিজ্য বন্দর। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নাটোর ক্রমশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে । নারদ নদীর মুখ বালি দ্বারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বন্যার দূষিত পানি নাটোর শহরে আটকে পড়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয় । শহরাসি বিভিন্ন পীড়ায় আক্রান্ত হতে আরম্ভ করে। এই দুরবস্থায় কতৃর্পক্ষ জেলা সদরদপ্তর রাজশাহীর শ্রীরামপুরে স্থানান্তরিত করে ১৮২৫ সালে। ফলে শ্রীরামপুর শহরে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ১৮৫০ সালে প্রবল বন্যা হয় এবং শ্রীরামপুর নদী গভে ভেঙ্গে পড়ে এবং পার্শ্ববর্তী বুলনপুরে সরকারী প্রশাসনিক দপ্তর স্থানান্তরিত করা হয় ও এখনও সেখানে বিদ্যমান।
২০০১ সালে আদম শুমারীর সময় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকাকে ৩৫টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছিল। তাই পরিসংখ্যানে ৩৫টি ওয়ার্ড ভিত্তিক করা হয়েছে। তবে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের (২০০২ সাল) পূর্বেই ৩৫টি ওয়ার্ডকে পুনঃরায় ৩০টি ওয়ার্ডেই বহাল রাখা হয়।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন
পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশন
১৮৭৬ সালের ১ এপ্রিল ভুবন মোহন পার্কের অভ্যন্তরে টিন সেডের দুটি কক্ষে রাজশাহী পৌরসভা (রামপুর-বোয়ালিয়া মিউনিসিপ্যালিটি) কাযর্ক্রম শুরু করে। পরে ভুবন মোহন পার্ক থেকে রাজশাহী কলেজের একটি বৃহৎ কক্ষে পৌরসভা দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। রাজশাহী পৌরসভার কাযর্ক্রম পরিচালনার জন্য রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ হর গোবিন্দ সেনকে প্রথম চেয়ারম্যান করে মোট ৭ সদস্য বিশিষ্ট প্রথম টাউন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সকল সদস্যই ছিলেন সরকার মনোনীত। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক ও মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন পদাধিকার বলে সদস্য। পরবর্তীতে পৌর নিবার্চনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের পদ্ধতি প্রবতর্ন করা হয়। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান কমিশনারগণের ভোটে নির্বাচিত হতেন। বেশির ভাগ কমিশনারই করদাতাদের ভোটে নিবার্চিত হতেন। ১৮৮৪ সালে মিউনিসিপ্যালিটি অ্যাক্টের ৩নং ধারা মতে ২১ জন কমিশনারের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তম্মধ্যে ১৪জন ছিলেন নিবার্চিত এবং ৭ জন মনোনীত। ১৯২১ সালে সোনাদীঘির পাড়ে বতমান পৌর ভবনটি নির্মিত হলে রাজশাহী কলেজ থেকে পৌরসভা দপ্তর, সিটি ভবনে স্থানান্তরিত হয়। পৌর সেবা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯৩০ সালে ৮টি পৌর কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটিগুলো প্রথকভাবে অর্থ, গণপূর্ত, আলো, পানি পয়ঃপ্রণালী ও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আপীল (Appeal) এবং রাজা টি. এন. রায় প্রতিষ্ঠিত সদর হাসপাতাল কাযক্রম পরিচালনা করত। নির্বাচিত পরিষদের সভায় কমিটি গুলোর সুপারিশ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। এক বছর মেয়াদে কমিটি গঠিত হতো এবং পৌর এলাকা ছিল ৭টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। ১৮৭৬ সালে যখন পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন লোক সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ হাজার জন। ১৮৭৬ সালে পৌরসভার একটি মিউনিসিপ্যাল বোর্ডও গঠিত হয়। ১৯৫৯ সালে মৌলিক গনতন্ত্র আদেশের বিধান অনুযায়ী মিউনিসিপ্যাল বোর্ডই মিউনিসিপ্যাল কমিটি হিসাবে কাজ করে আসছিল। মিউনিসিপ্যাল কমিটির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার আয়তন ছিল ৬.৬৪ বর্গ মাইল পশ্চিমে হড়গ্রাম বাজার থেকে পূবে রুয়েট পযর্ন্ত ছিল এর এলাকা। লোকসংখ্যা ৫৬৮৮৩ জন। ১৯৫৮ সালের ৫ অক্টোবর তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে. এম. এস রহমান সরকারী নির্দেশে মিউনিসিপ্যাল কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী পযর্ন্ত মরহুম এ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান এম. এ. এল এল. বি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নিবার্চিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পট পরিবতর্ন হয়ে ১৯৮৭ সালের সালের ১৩ আগষ্ট রাজশাহী পৌরসভা পৌর কর্পোরেশনে উন্নীত হয় এবং এ্যাভোকেট আব্দুল হাদী রসকার কতৃর্ক প্রশাসক মনোনীত হন। ১৯৮৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পৌর কর্পোরেশন সিটি কর্পোরেশনে পরিণত হলে জনাব আব্দুল হাদী প্রথম মেয়র মনোনীত হন। পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হওয়ার এর আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যানুসারে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের বতর্মান আয়তন ৯৬.৭২ বর্গ কিলোমিটার। তবে অধের্ক এলাক নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় স্থল এলাকা দাঁড়িয়েছে ৪৮.০৬ বর্গ লিলোমিটার। পযার্য়ক্রমে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের যারা মনোনীত মেয়র বা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন জনাব দুরুল হুদা, আলহাজ্জ মেসবাহ উদ্দীন আহম্মেদ, মোঃ সাইদুর রহমান (বিভাগীয় কমিশনার), এর.এ হবিবুল্লাহ (বিভাগীয় কমিশানর), মোঃ মিজানুর রহমান মিনু, আলহাজ্ব এম আমিনুল ইসলাম (বিভাগীয় কমিশনার)। ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারী রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র নিবার্চন অনুষ্ঠিত হলে মোঃ মিজানুর রহমান মিনু বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালের ১০ মার্চ তৎকালিন প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে শপথ বাক্য পাঠ করে পরের দিন ১১ মার্চ মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের পুনরায় নিবার্চন হন। ৫ মে ২০০২ মোঃ মিজানুর রহমান মিনু প্রধানমন্ত্রী বেমগ খালেদা জিয়ার নিকট ও ৭ মে ২০০২ নির্বাচিত কমিশনারবৃন্দ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূইয়ার নিকট শপথ গ্রহণ করেন। ২৯ মে ২০০২ বিশেষ ধারণ সাধারন সভার মাধ্যমে নির্বাচিত পরিষদের কাযর্ক্রম শুরু হয়। এই পরিষদের মহিলাদের জন্য ১০টি সংরক্ষিত আসনে ১০ জন কমিশনার ও ৩০ টি ওয়ার্ডে ৩০ জন কমিশনার সবর্মোট ৪০ জন কমিশনার নিবার্চিত হন।
ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলন বিশ্বের এক নজীর বিহীন ঘটনা। যার অন্তরনিহিতে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি। রক্তক্ষরণে বিশ্বের এই অদ্বিতীয় ঘটনাটি বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ জুড়ে শুধু মাত্র বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে ছিল। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান সাংস্কৃতিক সংঘ (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর মহান একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পর বিশ্ববাসীর ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়েছে। এই আন্দোলনের প্রাণ বিসর্জন শুধুমাত্র ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও মরণপণ আন্দোলন হয়েছিল দেশব্যাপী। তার মধ্যে রাজশাহী ছিল আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। আন্দোলরে সূচনা থেকেই রাজশাহীর বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, ছাত্র ও বিভিন্ন পেশার মানুষ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এর কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ( তৎকালে মেডিক্যাল স্কুল), ভুবন মোহন পার্ক ইতিহাস হয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক সাইদ উদ্দিন আহমদ ‘আন্দোলন ও নির্যাতনের দশক পঞ্চাশের দশক' প্রবন্ধে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা থেকে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের প্রথম রক্ত ঝরে রাজশাহীতে এবং প্রথম শহীদ মিনারটিও এখানেই তৈরী হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দেশব্যাপী ভাষা দিবস পালন উপলক্ষে রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা যে মিছিল বের করে তার ওপর কিছু লোক লাঠি-সোটা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লে নগরীর ফায়ার ব্রিগেডের মোড়ে (তৎকালীন তফজুল মিয়ার মোড়) আহত হন ছাত্র ফেডারেশনের নেতা আব্দুল লতিফ, ব্রতীশ ঘোষ, ফজলুর রহমান প্রমুখ। আর প্রথম শহীদ মিনারটি তৈরী হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে রাজশাহী কলেজ নিউ হোষ্টেল প্রাঙ্গনে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েকদিন পর ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার দাবি জানান। ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর। রাজশাহীতেও এর শাখা গড়ে উঠিছিল। ১৯৪৭ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবানেই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেয়া হয়। হরতালেই ভাষা আন্দোলনের প্রথম রক্তক্ষরণ ঘটে রাজশহীতে। সে কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে । এই হরতালে বেশ কিছু অধ্যাপক ছাত্রদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। প্রখ্যাত ধ্বনি বিজ্ঞানী মুহম্মদ আব্দুল হাই, প্রখ্যাত পন্ডিত ও গবেষক ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক, প্রখ্যাত পন্ডিত ও গবেষক ডঃ গোলাম মকসুদ হিলালী রাজশাহী কলেজে অধ্যাপনার ফলে এখানকার ভাষা সৈনিকদের তাদের নিকট থেকে সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
১৯৪৮ সালে এখানকার ভাষা আন্দোলন রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীক ছিল। রাজশাহী কলেজের সংগ্রামী ছাত্ররা আন্দোলনের গতিধারা চিহিত করতেন এবং সঠিক নেতৃত্বের দ্বারা ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হন। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে আতাউর রহমান, মুহম্মদ একরামুল হক ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে এবং পরবর্তীতে কাশেম চৌধুরীও গ্রেফতার হন। হাবিবুর রহমান শেলী ও মুহম্মদ সুলতান পড়া-শুনার জন্য ১৯৪৯ সালে ঢাকায় চলে আসেন। এর ফলে নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হলে ও এস. এ. বারী, গোলাম আরিফ টিপু, আহমদুল্লাহ চৌধুরী, মোহম্মদ আনসার আলী, মহসীন প্রমাণিক, আবুল কালম চৌধুরী, এস. এম. এ. গাফ্ফার, হাবিবুর রহমান প্রমুখের বলিষ্ঠ ভূমিকায় এ শূন্যতার সমস্যা প্রবল না হয়ে ভাষা আন্দোলনের গতি আরো তীব্র হয়ে ওঠে।
রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯৫০ সালে গঠিত ‘দিশারী সাহিত্য মজলিশ' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনটি দিশারী নামের একটি পত্রিকাও প্রকাশ করত। রাজশাহী কলেজে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কিছু ছাত্র আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। তারা ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারী কলেজের কমনরুমে সভাও করে। এই সভায় আরবিকে রাষ্ট্রভাষার জন্য আইনসম্মত আন্দোলন চালানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই আশ্চযর্জনক ও নিন্দনীয় কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে সফল ভূমিকা পালন করেছিল দিশারী সাহিত্য মজলিশ। দিশারী পত্রিকাও ভাষা আন্দোলনে তরুণদের উৎসাহিত করেছিল। রাজশাহী জেলা তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ আনসার আলী।
রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের গতি ক্রমশ বেগবান হওয়ায় ১৯৪৮ সালে যেসব নেতৃবৃন্দ বিরোধী ছিলেন, চরম পর্যায়ে তারাও বাংলা ভাষার দাবীতে সোচ্চার হয়েছিলেন। তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মহানগরীর ভুবন মোহন পার্কে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভার সভাপতি মোহাম্মদ আনসার আলীর মতে এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের দাবিতে প্রথম জনসভা। এই জনসভায় তৎকালীন স্থানীয় বিশিষ্ট জননেতা ক্যাপ্টেন শামছুল হক, মোসাদ্দারুল হক প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এই জনসভায় কিছু প্রস্তাব গ্রহীত হয়। যেমন- বাংলাকে পূর্ব বঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করা, আরবি হরফের প্রচলন বন্ধ করা, রাজশাহীতে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করা এবং বতমান বাজেট অধিবেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলটি সবপ্রথম গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ, কেন্দীয় অর্থ সাহায্য হতে ডিজি স্কুলের স্ম্প্রসারণ। এই জনসভার সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং রাজশাহীর জনগণকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। জনসভার জন্য প্রচারিত লিফলেট মুদ্রিত হয়েছিল রাজশাহীর তমোঘ্ন প্রেস থেকে।
এরপর রাজশাহীতে সবর্দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। মাদার বখ্শ (এম এল এ), ক্যাপেটন শামছুল হক, অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান (রাজশাহীর প্রাক্তন পৌর চেয়ারম্যান), হবিবুর রহমান, নূরুল ইসলাম (লালমিয়া ব্যবসায়ী), বামপন্থীনেতা আতাউর রহামন, এ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, ডাঃ মেসবাহুল হক বাচ্চু্, সাইদ উদ্দিন আহম্মদ (ব্যবসায়ী), এ্যাডভোকেট মহসিন প্রামাণিক, ইয়াসীন আলী, ডাঃ আব্দুল গাফ্ফার, বাবু প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী (প্রাক্তন মন্ত্রী), বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী প্রমুখ এই পরিষদের সদস্য ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসাবে রাজশাহীতে ও দিনব্যাপী হরতাল ও বিকেলে ভুবন মোহন পার্কে জনসভা অনুষ্ঠত হয়। রাজশাহী কলেজের ছাত্র হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এই জনসভায় শামসুল হক, আব্দুস সাত্তার, বেগম জাহানারা মান্নান বক্তৃতা করেন। জনসভা চলাকালে অনুষ্ঠনন পরিচালক হঠাৎ ঘোষণা করেন ঢাকায় পুলিশের গুলিতে য়েকজন ভাষাসৈনিক শহীদ হয়েছেন। সে সময় আব্দুস সাত্তার বক্তৃতা ফেটে পড়েন। তিনি আবেগে আগুন ঝরা বক্তব্য শুরু করেন এবং উপস্থিত জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ঢাকার শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতেই আন্দোলনরত ছাত্ররা রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেল প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার তৈরী করেন এই শহীদ মিনারটি বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার বলে রাজশাহীর ভাষাসৈনিকগন দাবি করেছেন। এই শহীদ মিনারের ছবিটি এ্যাড. মহসিন প্রমাণিকের সৌজন্যে পাওয়া যায়। নির্মাণের পূর্বের উক্ত হোস্টেল প্রাঙ্গণে এক ছাত্র সভায় মেডিক্যাল স্কুলে ছাত্র এস এম এ গাফফারকে সভাপতি এবং হাবিবুর রহমান ও গোলাম আরিফ টিপুকে যুগ্ম সম্পাদক করে একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় । এ পরিষদের কর্মকর্তারাই ছাত্র সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর
শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন।
শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও ভাষা আন্দোলনের গতিকে তীব্র করার লক্ষ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা ডাকে । কিন্তু পূর্ব থেকে পুলিশ পার্ক দখলে নেয়ার কারণে সভাটি অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজের টেনিস লনে। এদিন ছাত্ররা হরতালেরও ডাক দিয়েছিলেন। হরতালে জনগণ ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছিলেন। সমস্ত দোকান, যানবাহন, অফিস সব কিছুই বন্ধ ছিল। মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন আপামর জনসাধারণ। সমস্ত শহর পোষ্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। এর পর ভুবন মোহন পার্কে আর একটি বিশাল জনসভা অনষ্ঠিত হয়। এ সভার গুরুত্ব অপিরিসীম। সভাতে হাজির হয়ে দুজন প্রবীণ মুসলিমলীগ নেতা, এম এল এ ও রাজশাহী পৌরসভার সভাপতি মাদার বখ্শ ও ক্যাপ্টেন শামসুল হক নূরুল আমিনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। ১৯৫৩ সালে রাজশাহীতে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে ভুবন মোহন পাকে শহীদ মিনার নির্মান করে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে অনেক মহিলা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে তারা রাজনীতেতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন না। যারা আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন ডঃ জাহানারা বেগম বেনু, মনোয়ারা বেগম মনু (মাদার বখশের কণ্যা), ডাঃ মহসিনা বেগম, ফিরোজা বেগম ফুনু, হাফিজা বেগম টুকু, হাসিনা বেগম ডলি, রওশন আরা, খুরশীদা বানু খুকু, আখতার বানু প্রমুখ। মহিলা ভাষা সৈনিকেরাও ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিলে ও জনসভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন জাহানারা বেগম রাজশাহীর প্রথম মহিলা যিনি ভুবন মোহন পার্কে বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা গানটি গেয়ে ভাষা সৈনিকদের উৎসহ জুগিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদী সভায় মেয়েদেরকে শামিল করার জন্য একটা পাল্কি গাড়িতে মাইকের বদলে চোঙ্গা নিয়ে বেরিয়েছিলেন হাফিজা বেগম টুকু, ফিরোজা বেগম ফুনু, হাসিনা বেগম ডলি, খুকু। কিন্তু রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলের কাছে পুলিশের তাড়া খেয়ে শেখপাড়া হোসেনীগঞ্জ মাদ্রাসা হাই স্কুলের শিক্ষক মৌলভী আতাউর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভুবন মোহন পার্কের জনাকীর্ণ জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন মনোয়ারা ও মহসিনা।
ভাষা আন্দোলন শুধু রাজশাহী শাহরেই সীমাবদ্ধ ছিলনা । জেলার অন্যান্য মহকুমা শহর নাটের, নওগাঁ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ সহ গ্রামঞ্চলেও এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল। নমুনাস্বরূপ রাজশাহী জেলার অজগাঁ নাজীপুরের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী এখানকার ছাত্ররা হরতাল ও প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়েছিল । এই সংবাদটি আজাদ পত্রিকার ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী বুধবার ৪র্থ পৃষ্ঠায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবীতে সর্বত্র হরতাল ও জনসভা শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।
রাজশাহীর কয়েক জন ভাষা সৈনিক ঃ সমাজ সেবক মাদার বখশ, ক্যাপ্টেন শামসুল হক, জননেতা আতাউর রহমান, শহীদ বীরেন্দ্রনাথ সরকার, মোহম্মদ সুলতান, অধ্যাপক মুহাম্মদ একরামুল হক, ডক্টর কাজী আব্দুল মান্নান, ডক্টর আবুল কশেম চৌধুরী, বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী, ডাঃ এম লতিফ, বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী, এ্যাডভোকেট মহসীন প্রামাণিক, নাট্যকার মমতাজ উদ্দীন আহমদ, এ্যাডভোকেট আবুল কালাম চৌধুরী, লুৎফর রহমান মল্লিক ডলার, ডাঃ এসএম আব্দুল গাফফার, ডাঃ মেসবাউল হক এ্যাডভোকেট মোঃ আব্বস আলী, এমএ সাঈদ, এ্যাডভোকেট আহমদ, উল্লাহ চৌধুরী, আব্দুল মালেক খান, সাংবাদিক সাইদ উদ্দিন আহমদ, মজিবুর রহমান, ডাক্তার আজিজুল বারী চৌধুরী, এ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর হোসেন স্পেন, ডক্টর বেগম জাহান আরা, বেগম মনোয়ারা রহমান, ডাঃ মোহসেনা বেগম, হাফিজা বেগম টুকু, জামাল উদ্দিন আহমদ, লেখক মুহম্মদ শুকুর উদ্দিন ইবনে খৈয়াম, আশরাফুল আবেদিন, মহিদউদ্দন আহমদ, প্রফেসর মোহাম্মদ আবুল হোসেন, এ্যাডভোকেট মোঃ সমসের উদ্দিন, এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জিয়ারত উল্লাহ, আব্দুস সাত্তার মাস্টার, মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী নীলূ, ফিরোজা বেগম, হাসিনা বেগম, রওশন আরা, খুরশীদা বেগম, আখতার বানু প্রমুখ।
আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ
প্রাচীন বা মধ্যযুগেও আমাদের দেশে যুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু তা মূলত রাজায় রাজায় ও তাদের সৈন্য সামন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা বা জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জনগণের সক্রিয়তার কথা জানা যায় না। এ করণে ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনায় মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ইখতিয়ার মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী লক্ষণসেনের রাজধানী নদীয়া দখল করেছিলন। তার সাড়ে পাঁচশ বছর পর সুদূর ইউরোপীয় বণিকরা গুটি কয়েক সৈন্য নিয়ে বাংলা দখল এবং পরবর্তীতে ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা দখল করে প্রায় দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করে গেছে প্রায় দুশ বছর। আর একটি লক্ষনীয় বিষয় হলো ভারতে বর্য়ে যে সময়ে বৃটিশ শাসনের শুরু, তার অল্পকাল পরেই বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। তৎকালের তের কলোনীতে বিভক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আপনা আপনি রথে চড়ে আসেনি। এর জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, এ অঞ্চল তথা ভারতবর্ষের মানুষ পরিশ্রমী ও সম্পদশালী থাকলেও দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌত্বের বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। এর ফলে মোগল, পাঠান সর্বশেষ ইউরোপীয় ইংরেজরা রাজমন্ডপে বসে শাসনের চাবুক কষেছেন এদেশের মানুষকে। গোরা চামড়ার ইংরেজ প্রভুরাই হয়ত এদেশের কিছু সচেতন মানুষকে আলাদা কিছু ভাবতে শিখিয়েছিলেন। তাই ইংরেজ শাসনামল থেকেই দেশমু্ক্তি বা অন্যান্য জাতীয় আন্দোলনে জনসাধারণের সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়। এসব আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষ তথা রাজশাহী মহানগরীর মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও রাজশাহী
জাতীয় স্বার্থে এদেশের মানুষ যত ইতিহাস রচনা করেছে, তার প্রতি ঘটনাতে রাজশাহী মহানগরী অসীম উদ্দিপনায় সাহসী ভূমিকায় অটল থেকেছেন। এ কথায় সত্য, বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জন ও যে কোন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও সংগ্রাম গড়ে তোলায় এখানকার মানুষের বৈশিষ্ট্য। জাতির শ্রেষ্ঠ ইতিহাস মহান মুক্তিযুদ্ধ, যার ভিত্তি মহান ভাষা আনন্দোলন, সেই আন্দোলন থেকে পরবর্তীতে পাক শাসক গোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়ন আর অগ্রণতান্ত্রিক আচারণের বিরুদ্ধে যতগুলো আন্দোলন গড়ে উঠেছে প্রায় কোনটাতেই এই মহানগরী পিছিয়ে ছিলনা। দেখা যায় ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়েছিল বৃহত্তর রাজশাহীর রহনপুরে (বর্তমানে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত)। এ বিষয়ে মনসুর আহমদ খান সম্পদিত মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গ্রন্থের ৬৮ প্রষ্ঠায় মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির মন্তব্যে উল্লেখ আছে, ৭১ সালের ২৩ মার্চ একজন পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্য রহনপুর ইপিআর ক্যাম্পে সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গেলে বাঙ্গালী সৈন্যরা পাঞ্জাবী সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পরদিন ২৪ মার্চ একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্য ঘটনা তদন্ত করতে গেলে বাঙ্গালী হাবিলদার আক্কাস পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে গুলি করে হত্যা করেন। ২৩ মার্চের গুলিবর্ষণ ও ২৪ মার্চের পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে হত্যার মধ্যদিয়ে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে মুক্তি পাগল বাঙ্গালী ( মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির মন্তব্যটি ২০/৭/১৯৯৩ তারিখের আসলাম সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক দুনিয়ায় প্রকাশিত হয়)।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু হলেও এদেশের মানুষ তার পূর্বেই মানসিকভাবেই আলাদা হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নিবার্চনের বিজয় তারই ফলশ্রুতি। পাক শাসকগোষ্ঠীর গণতন্ত্র ও এদেশের মানুষের প্রতি যে বিন্দু মাত্র ভক্তি ও ভালবাসা ছিলনা তা এই নিবার্চনের ফলাফল থেকেই অত্যন্ত স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সামরিক প্রেসিডেন্ট লেঃজেঃ ইয়াহিয়া খান ও মার্চে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঘোষণা করার পরপরই বাংলাদেশের তৎকালের পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র মানুষ জ্বলে উঠেছিল। বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল রাজশাহীতেও। ১ মার্চ দুপুরে রাজশাহী কলেজে খুরশিদ বিন আলমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস (সাবেক প্রতিমন্ত্রী) ঐ সভায় ভাষণ দেন। এছাড়া ছাত্রলীগ নেতা আব্দুস সামাদ, মাহফুজুর রহমান খান, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হাবিবুর রহমান টুকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় একটি ছোট পাকিস্তানী পাতাকায় আগুন লাগানো হয়। খুরশিদ আলম কলেজ অফিসের ছাদে উঠে পাকিস্তানী পাতাকাটিতে আগুন লাগান। সভা শেষে কোর্ট অভিমুখে মিছিল বের হয়। ঐ মিছিল বেতার কেন্দ্র, এসপি অফিস, ডিসি অফিস, জজ কোর্টের পাতাকাতে আগুন ধরায়। ঐ দিন রাজশাহী কলেজের ঐ সভায় এক দফা স্বাধীনতার দাবি করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র সমাজ ১ মার্চ হতে ৩ মার্চ ক্যাম্পাসে ও শহরে জঙ্গী মিছিল বের করেছিল। ৩ মার্চ হরতাল ও মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোর্ট পযর্ন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদ গর্জে উঠেছিল মিছিলে মিছিলে। পুলিশ লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস ও গুলি নিক্ষেপ করে মিছিলে বর্বরতা চালায়। বেলা সাড়ে এগারটার দিকে মালোপাড়া টেলিফোন ভবনের ওপর থেকে বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবষর্ণ করে বাটার মোড়ে একজন ছাত্রকে হত্যা করে। এর ফলে রাজশাহীর ছাত্র, বুদ্ধিজীবীসহ সব পেশার মানুষ আরো অশান্ত হয়ে ওঠেন। পাক বাহিনী সান্ধ্য আইন জারী করেছিল এবং ১২ ঘন্টার সময় দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হল ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। উপাচার্য এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপসারিত হন। ৫ মার্চ গুলিবষর্ণের প্রতিবাদে ভুবনমোহন পার্কে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ সভা করে। এদিন পাকসেনারা সাহেব বাজারের শাকসজি লুট করে নিয়ে যায়।
৮ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা মিয়াপাড়াস্থ সাধারণ গ্রস্থাগারের চত্বরে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য যোদ্ধা বাছাই কর্মসূচি শুরু করে এবং যুবকরা দলে দলে যোগ দেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মালেক চৌধুরী। ১০ মার্চ রাজশাহী শহর থেকে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়া হয়। ১১ মার্চ ভুবন মোহন পার্কের জনসভায় এএইচএম কামারুজ্জামান ভাষন দেন। ১২ মার্চ ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুসহ অন্যান্য শিল্পীরা স্বাধীনতার স্বপক্ষে রাজশাহীর বিভিন্ন রাস্তায় গণ সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন রাতে বোমা বানানোর রসদ সংগ্রহের জন্য কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সায়েন্স ল্যাবরেটরী লুট হয়। ১৩ মার্চ জনতার আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে ওঠে। ১৪, ১৫ ও ১৬ মার্চ সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্যাপকভাবে মাঠে নামে এবং শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে পথে পথে, ম্মুক্ত মঞ্চে ট্রাকযোগে দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৭ মার্চ স্বাধীণ বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর আহবায়ক হয়েছিলেন আব্দুল কুদ্দুস ও শরিফ উদ্দিন। এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজশাহী মহানগরীতে উদ্দীপনামূলক গণসংতীতের আয়োজন করে। ১৮ মার্চ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র কর্মীদের দ্বারা বানানো বোমা পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১৯ মার্চ ভাটাপাড়া লক্ষীপুরে গঠন করা হয় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ। এদিনই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২০ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে নগরীব্যাপী কালো পতাকা উড়ানো হয়। ২১ মার্চ নগরীব্যাপী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছোট ছোট ইউনিট গঠন করে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করার উদ্দেশ্যে যুবকদের একত্রিত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২২ মার্চ থেকে প্রকাশ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয় এবং রাতে একটি স্কুলের সায়েন্স ল্যাবরেটরী লুট হয়।
২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ লাইনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশীহী কলেজ তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান রাজশাহী ও রাজশাহী কোর্টেও পতাকা উত্তেলন করা হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেন, ডাঃ আব্দুল মান্নান, মাহফুজুর রহমান খান, আব্দূল মান্নান প্রমুখের নেতৃত্বে নগরীতে ছাত্র- যুবকের সমন্বয়ে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর টহলের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর টহল চলে মহল্লায় মহল্লায়। ২৫ মার্চ মিছিল ও দিবাগত রাতে ভুবন মোহন পার্কে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে রক্ত কথা বলে নাটক মঞ্চস্থ হয়। (মুনসুর রহমান খান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের রাজশাহী গ্রস্থে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ভুবন মোহন পার্কে অনুষ্ঠিত নাটকটির নাম রক্ত কথা বলে উল্লেখ থাকলে ও রাজশাহী বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি সমাবেশ ২০০৩ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় নাটকটি রক্তের রঙ লাল নামে উল্লেখ আছে।) এটি রচনা করেন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্র শিল্পী আতাউর রহমান।
পাক সরকারের নির্দেশে ২৭ মার্চ লাইসেন্সকৃত বন্দুক জমাদান শুরু হয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় জমা দেওয়ার পথে সাহসী যুবকেরা এসব বন্দুক কেড়ে নিয়েছিল যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। বন্দুক কাড়াকাড়ির নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ সারোয়ার হোসেন, ডাঃ শাফিক প্রমুখ। ২৮ মার্চ পাক আর্মি ও পুলিশের যুদ্ধ চালাকালে পুলিশ লাইনের পাশ্ববতী এলাকায় বুলনপুর, ভেড়িপাড়াসহ কোর্ট এলাকা ও নগরীর সাধারণ মানুষ খাদ্যসহ পুলিশকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। কোর্ট বাজারের ডাক্তার গাফফারের বাড়ীকে হেড কোয়ার্টার বানিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষ সংগঠিত হন ও বিভিন্ন তৎপরতা আরম্ভ করেন। নগরীর পূবাঞ্চলে তালাইমারী মহল্লায় জেবের মিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন। শেখর চক ও আলুপট্টি এলাকায় সূর্যশিখা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর কার্যালয়ে ও হেতমখায়ে মুসলিম হাই স্কুলের ভিতরে একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এভাবে নগরীর সবর্ত্র কারো না কারো নেতৃত্বে যুদ্ধেচ্ছুক যুব শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হয়। ১ এপ্রিল পযর্ন্ত পুলিশ, আনসার, দু-একজন প্রাক্তান সৈন্য, ইউওটিসি ও মুজাহিদ ট্রেনিং প্রাপ্তদের সহযোগিতায় প্রতিরোধ যুদ্ধ, চোরাগুপ্ত হামলা ও রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। পুলিশ লাইনের পতনের দিনই কোর্ট এলাকায় বশড়ি ইট ভাটার কাছে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কমান্ডার হারুন উর রশিদের নেতৃত্বে পাক সেনাদের একটি টহল দলে আক্রমণ করা হয়। এতে একজন পাক সেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। সম্ভবত রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনার মৃত্যু এটাই প্রথম। ৩১ মার্চ রাজশাহী-নওগাঁর ইপিআর এর ৭নং উইং এর সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, ৭নং উইং এ সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার মেজর নজমুল হক এক কোম্পানী ইপিআর নিয়ে রাজশাহী পৌছে নগরীর উত্তরে নওহাটায় অবস্থান গ্রহণ করেন। চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে ৫০০ জন ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও ছাত্রদের সমন্বিত একদল মুক্তিযোদ্ধা নগরীর অদূরে পশ্চিমে এসে পৌছে। সারদা ক্যাডেট কলেজে কর্মরত ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পূর্ব দিক থেকে রাজশাহী নগরীর দিকে অগ্রসর হয়।
এ ঘটনার ফলে প্রতিরোধ যুদ্ধের গতি সঞ্চারিত হয়। ঐ দিন রাতেই আলোচনার মাধ্যমে ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহীর প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ২ এপ্রিল ভোরে ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে নগরীর পশ্চিম দিক থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা কাঠালবাড়িয়া আমবাগান এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বেও একদল মুক্তিযোদ্ধা পূর্ব দিকে ভদ্রা এলাকায় অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বাধীন ইপিআর সুবেদার লস্করের নেতৃত্বে তার বাহিনী পূর্ব দিক থেকে নগরীতে ঢুকে পড়লেও পরে ফিরে যায় হর্টিকালচারের পাশে জেবের মিয়ার ইটভাটার কাছে। এদিকে ঢাকা থেকে আগত পাকিস্তানী যুদ্ধ বিমান হামলা চালিয়ে বেসামরিক লোককে হত্যা ও ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে। কেন্দ্রীয় কারাগারও আক্রান্ত হয়। এর ফলে বন্দীরা লকআপে না গিয়ে সবাই ৩ এপ্রিল জেল ভেঙ্গে পালিয়ে যায়। এসময় কারা রক্ষীদের গুলিতে ১৪ জন কয়েদি মৃত্যুবরণ করেন। ৬ এপ্রিল পযর্ন্ত পাক বাহিনী নগরীর কয়েকটি গুরুত্বপূণ স্থানে অবস্থান নিয়ে থাকে। এরপর ক্যাপ্টেন গিয়াস একদল সৈন্য সমেত বগুড়া ও মেজর নজমুল রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসেন। পরে ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহী অভিমুখে অগ্রসরমান মূল দলের সঙ্গে যোগ দেন। গিয়াসের নেতৃত্বে ইপিআর, আনসার, পুলিশ, ছাত্র ও বিভিন্ন পেশার মানুষ মিলে এক হাজার সৈন্য এবং সারদা হতে এক হাজার সৈন্য ২ এপ্রিল রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে সমবেত হয়। ৩ এপ্রিল বিএসএফ এর লেঃ কর্ণেল সেন ও মেজর ত্রিবেদী ক্যাপ্টেন গিয়াসের সঙ্গে দেখা করেন। ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহী শক্রমুক্ত করার জন্য তাদের নিকট প্রয়েজনীয় সাহায্য চেয়ে না পেয়ে অবশেষে পরিকল্পনা মাফিক ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬-৭টার দিকে শক্রদের ওপর প্রবল আক্রমণ করেন। অদম্য সাহসের মধ্য দিয়ে প্রায় চার ঘন্টা লড়াই এর পর রাজশাহী শক্রমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহরের চতুর্দিকে তাদের প্রতিরক্ষা তৈরী করে। এ যুদ্ধে কিছু সংখ্যক পাক সেনা নিহত হয় ও ৩০/৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে প্রয় তিন হাজার অস্ত্র ও তিন লাখ গুলি উদ্ধার করে। শহরের লোকের মধ্যে উল্লাস দেখা দেয়। এদিকে পাক সেনারা তাদের ছাউনি পশ্চাদপসরণ করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করে। তারা বিমান হামলাও আরম্ভ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ৭-১০ এপ্রিল ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে পাক সেনা ছাউনির চতুদিকে ঘিরে ফেলে। এতে পাক সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং সে এলাকার বিহারীদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরীতে সাহ্যায্যের নির্দেশ দেয়। তার পূর্ব থেকেই বিহারী কলোনীর বিহারীরা পাক বাহিনীর ছত্র ছায়ায় ঐ এলাকায় বসবাসকারী ও পথচারীর অনেককে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
৮ই এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০ টায় ডাক বাংলায় (বতমান আর এম পি হেড কোয়ার্টার) আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাড. আব্দূল হাদীকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ সভায় আব্দুল হাদী, ক্যাপ্টেন গিয়াস, মোস্তাফিজুর রহমান খান, মাহতাব উদ্দিন, শফিকুর রহমান রাজা, মহসীন আলী, সাইদুর রহমান, ডাঃ টুকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এসময় নির্বাচিত এমএনএ এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনা কৌশলগত কারণে কোলকাতায় অবস্থান করছিলেন। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে গণবাহিনী প্রধান মাহতাব উদ্দিন ও শফিকুর রহমান রাজা তাকে রাজশাহীতে আনার জন্য ভারত গমন করেন। তারা মুর্শিদাবাদ প্রশাসনের সহযোগিতায় ১২ এপ্রিল বিকেলে সাজসরঞ্জমসহ বিবিসির রিপোর্টারদের রাজশাহী নিয়ে আসেন। তারা মিশন হাসপাতালে এক সময়ের সহকারী ভারতীয় হাই কমিশনারের বাসভবনে অবস্থান করেন এবং কাঠালবাড়িয়া আমবাগানের পার্শ্বে প্রাইমারী স্কুলে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের কোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন গিয়াসের সাক্ষাৎ নেন এবং বেশ কিছু চিত্র ভিডিওতে ধারণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাক সেনা ছাউনি দখলের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত তখন ১০ এপ্রিল পাক সেনাদের দুই ডিভিশেন সৈন্য হেলিকপ্টার, স্টিমার ও ফেরীর মাধ্যমে নগরবাড়ী ঘাটে অবতরণ করে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ বাধা দেয়ার জন্য নগরবাড়ী অভিমুখে রওনা দেন। তারা ১১ ও ১২ এপ্রিল পাবনার মুলাডুলী, রাজশাহীর সারদা রোডের মোড় ও শহরের অনতিদূরে কয়েকটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করেও টিকতে পারেননি। সারদার কাছে তুমুল যুদ্ধে কোম্পানী কমান্ডার এবি সিদ্দিকিসহ (সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক) বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। (শহীদ এবি সিদ্দিকিকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।)
১৩ এপ্রিল ভোরে পাক সেনারা রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয় পৌছে আর্টিলারী ফায়ার ও জংগী বিমানের গোলা বষর্ণ আব্যাহত রাখে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা, জিন্নাহ ও অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে নেয়। ধ্বংস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। হাবিব ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরী প্রভৃতিতে লুটতরাজ চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়েকে কেন্দ্র করে তারা আশেপাশের এলাকাতেও হত্যা ও নিযাতন আরম্ভ করে। ঐদিন বিমান হামলায় মুসলিম হাই স্কুলে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের হেড কোয়ার্টার তছনছ হয়ে যায়। ১৪ এপ্রিল রাত দুটার দিকে পাক গোলন্দাজ বাহিনী বৃষ্টির মত গোলা বষর্ণ শুরু করে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তাদের এক ডিভিশণ সৈনা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের প্রচন্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে মূল দলটি চাঁপাই নবাবগঞ্জের দিকে সরে আসতে বাধ্য হন। এর ফলে রাজশাহী শহর পাক সেনাদের দখলে চেলে যায়। স্থানীয় বিহারীদের সহযোগিতায় পাক বাহিনী নগরীতে হত্যা, ধষর্ণ, লুট, আগুন জ্বালানোসহ ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বেলা প্রায় দুটার দিকে ক্যাপ্টেন গিয়াস তার সাথীদের মধ্যে ৩০০ জনকে খুজে পান। তাদের নিয়েই তিনি রাজশাহী শহর থেকে ১৮ মাইল পশ্চিমে ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে ১২ মাইল পূর্বে গোদাগাড়ী নামক জায়গায় পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করেন। এখান থেকে নুরুল ইসলাম নামে একজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা ১৫ এপ্রিল ও ১৬ এপ্রিল নুরুল ইসলামসহ ক্যাপ্টেন গিয়াস মুর্শিদাবাদের জেলা প্রশাসক ও বিএস এফ এর সঙ্গে দেখা করেও সাহায্য পাননি। ১৭ থেকে ২০ এপ্রিল পাক সেনারা জঙ্গী বিমানের মাধ্যমে গোদাগাড়ী মুক্তিযোদ্ধা ঘাটি ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে গোলাবষর্ণ করে। এর ফলে চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের লোকজন পালিয়ে যায়। ২১ এপ্রিল খুব ভোর থেকে পাক সেনারা প্রবল গোলা বষর্ণ আরম্ভ করে। এর ফলে বেলা ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোদাগাড়ি প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে পড়ে। পাক সেনারা চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর দখল করে নেয়। ইপিআরের ২ টি স্পীড বোট দিয়ে সমস্ত গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্দাদের নিয়ে ক্যাপ্টেন গিয়াস পদ্মা নদীর চরে আশ্রয় গ্রহণ করেন।এদিকে ক্যাপ্টেন রশিদ চারঘাট এলাকা থেকে তার দল নিয়ে পদ্মা অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেয়। কেবল চর ছাড়া রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জসহ সমগ্র এলাকা পাক সেনাদের দখলভুক্ত হয়।
এদিকে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশেকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে। রাজশাহী, পাবনা, বগুড়াও দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে ৭নং সেক্টর গঠিত হয়। এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছিল লেঃ কর্ণেল নুরুজ্জামানকে। এই সেক্টরকে ৯টি সাব সেক্টরে বিভক্ত করে ৯ জন সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছিল। (মনসুর আহমদ খান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গ্রন্থে ওয়াহিদা আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী প্রবন্ধে ন'জন সাব সেক্টর কামান্ডারের উপরোক্ত নাম উল্লেখ থাকলেও গিয়াস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বীর বিক্রম ০৯.০৪.২০০৭ তারিখে স্বাক্ষরিত আত্মজীবনীতে ৪ নং সাব সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার থাকার কথা উল্লেখ করেছেন) এই সাব সেক্টরগুলো ব্যতীত স্থানীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্নভাবে রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ করেন।
২৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আসাদ আহমদ বায়রনের নেতৃত্বে চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানপুরে এক গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে নাম নাজানা মাত্র এগার বছরের এক কিশোরের দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে বীরত্বের পরিচয় দেয়। রাত সাড়ে নটার দিকে দুর্লভপুর গেরিলা শিবির থেকে বায়রনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা নৌকা যাত্রা আরম্ভ করে। রাত পৌনে এগারটায় কানপুরের নিকট পৌছে একটা আখক্ষেতে নৌকা বেধে ঐ দুঃসাহসী কিশোরের পথ নির্দেশনায় এক বুক পানি ভেঙ্গে যাত্রা আরম্ভ করেছিল। একটা আমবাগানে পৌছতেই শিবগঞ্জ ক্যাম্প থেকে পাক সেনারা গোলাগুলি শুরু করে। বাগানের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হয়েছিল। এরপর কাছে নিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবী ও রাজাকারদের ট্রেঞ্চ ও বাংকারগুলো দেখিয়ে দিয়ে নিজেই ক্রলিং করে পাহারারত রাজাকারকে গলা টিপে হত্যা করে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল এই কিশোরটি। দলীয় নেতার নির্দেশমত পাঞ্জাবী বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করেছিল গেরিলারা। প্রচন্ড বিস্ফোরণের সংগে সংগে বাংকার ধ্বসে পড়ে এবং অবস্থানরত তিনজন পাঞ্জাবীই প্রাণ হারিয়েছিল। পাশের বাংকারে গ্রেনেড চার্জের ফলে চারজন রাজাকার মারা পড়ে । পার্শ্ববর্তী এক বাড়ি থেকে দুজন রাজাকার ও তিনজন দালাল পাঞ্জাবীদের কাছে খবর দেবার উদ্দেশ্যে পালানোর পথে গেরিলাদের লক্ষ্য অভ্রষ্ট গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে পাঞ্জাবীরা খবর পেয়ে এক কোম্পানী সেনা ও রাজাকার নিয়ে আক্রমণের জন্য রওনা হয়। আখ ক্ষেতে রেখে আসা নৌকার পাহারারত গেরিলারা গুলি ছুড়ে এই পাঞ্জাবী কোম্পানীকে প্রচন্ডভাবে ঘাবড়ে দেয়। তারা ভালভাবে কিছু বোঝার পূর্বেই গেরিলা মুক্তিবাহিনী নৌকায় ফিরে আসে। ফলে বায়রনেরর নেতৃত্বে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কানপুর অপারেশন সফল হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা একটি এলএমজি, দুটি চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছিল।
১০ মে নায়েব সুবেদার মুবাশ্বেরুলের নেতৃত্বাধীন একটি দল চারঘাট থানা রেড করেন। এতে মিলিশিয়াসহ ১০ জন পাক সেনা নিহত হয় ও ৭ জন আহত হয়। ১৩ মে হাবিলাদার খন্দকার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে এক সেকশন মুক্তিযোদ্ধা সারদা পিটিসির পাকসেনা ঘাটি আক্রমণ করে ৬ জন পাক সেনাকে হত্যা করে। ১ জুন পাক কতৃর্পক্ষ রাজশাহী শহরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যায় খোলার নির্দেশ জারী করেছিল। ১ জুলাই শিক্ষকদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয় এবং ক্লাশ শুরু হয়েছিল ২ আগষ্ট। ২৩ জুন মুক্তিযোদ্ধারা প্রথাম গ্রেনেড হামলা করেছিল। ফলে পাওয়ার হাউজের প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল এবং শহরে দুদিন বিদ্যুৎ ছিলনা। মোঃ আব্দুল গফুরের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল এই হামলা চালায়।
সুবেদার মেজর মজিদের নেতৃত্বে ১০ আগষ্ট পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর শিবগঞ্জ থানার কলাবাড়ীতে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৬৪ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিলেন। সুবেদার মেজর মজিদ তার দলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ভোর সাড়ে পাঁচটায় পাক সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং দেড় ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর কলাবাড়ী মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে।
২২ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার অন্তভুর্ক্ত পাকঘাঁটি মীরগঞ্জ বিওপি আক্রমণ করলে পাক সেনাদের পাল্টা আক্রমণে পিছু হটে আসে। ২৩ আগস্ট ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদ যৌথভাবে পাক বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি কানসাট আক্রমণ করেন। পাক বাহিনীর প্রতিরোধ আক্রমণে মুক্তি বাহিনী ঐ দিন কানসাট থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। ২৬ আগস্ট পুনরায় কনসাটে যুদ্ধ হয়। প্রথমে মুক্তি বাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকসেনারা কানসাট ছেড়ে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই তারা পাল্টা আক্রমণ ও প্রচন্ডভাবে গোলাবর্ষণ করে। এই আঘাতে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে ৭নং সেক্টরের প্রতিটি সেক্টরেই পাকসেনাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা অবিরামভাবে আক্রমণ চালান।
৭ অক্টোবর রাজশাহী মহনগরীর কুঞ্জ মৈত্রের বাড়ির বৃহত্তম রাজাকার ঘাঁটি ও মোসলেম সাহেবের বাড়ির আলবদরের দপ্তর ধ্বংস করার জন্য বীরাঙ্গণা শওকত আরা একটি অভিযান চালিয়েছিলেন। এই সাহসী নারী পরিকল্পনা মাফিক একটি ২৪ ইঞ্চি টিনের ট্যাংকে ৪টি এ্যান্টি ট্যাংক মাইন, এক্সপ্লোসিভ ও ৪টি এসএমজি, বেশ কিছু গ্রেনেড ও কারবাইনের ম্যাগজিন ভর্তি করে একটি রিক্সা শহরে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পরিকল্পনা সফল হয়নি।
১৪ অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের সংঘর্ষে একজন পাক মেজরসহ ৩০ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয়। ২২ নভেম্বর শাহপুর গড়ে মুক্তি যোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সেনাদের যুদ্ধ শুরু হয়। চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শাহপুর গড়ের যুদ্ধই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। পাক বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল এবং শাহপুর গড় ছেড়ে তারা দলদলিতে চলে এসেছিল এবং অনেকে নদী অতিক্রম করে আলীনগরেও চলে গিয়েছিল। পরের দিন মুক্তিযোদ্ধারা শাহপুর গড় পুনর্দখলের অভিযান আরম্ভ করেন। পরিকল্পনা অনুসারে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মেহেদীপুর থেকে তার বাহিনী নিয়ে এসে শাহপুর গড় আক্রমণ করেন। লেঃ রফিক, নজরুল, আলতাফ, ওয়াশিল এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। প্রায় দেড় ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর পাকসেনারা শাহপুর গড় ছেড়ে বিষ্ণুপুর ও কসবা এলাকায় পালিযে যায়। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল নুরুজ্জামান এযুদ্ধের নেতৃত্বে দেন। এরপর আলীনগর ব্রিজের কাছে আক্রমণ চালালে পাঁচ পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া মোঃ রফিকের নেতৃত্বে আমবাগানে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে বহু পাকসেনা হতাহত হয় ও একজন পাক মেজর ধরা পড়ে । এযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুলতান শহীদ হন। ২৭ নভেম্বর ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে মুক্তি বাহিনীর ৫টি কোম্পানী পাকিস্তানসেনাদের শক্ত ঘাঁটি পোড়াগ্রাম আক্রমণ করে। দীর্ঘ স্থায়ী এই সংঘর্ষে ৩০ জন পাকসেনা ও ৫০ জন রাজাকার নিহত হয় এবং পাকসেনারা শেষ পযন্ত চাঁপাই নবাবগঞ্জে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
১০ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চাঁপাই নবাবগঞ্জের ওপর ব্যাপক হামলা আরম্ভ করে এবং এখানেই এক যুদ্ধে ১৪ ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শহীদ হন। এই দিনই চাঁপাই নাবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। ১৫ ডিসেম্বর সম্মিলিত মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনী রাজশাহী প্রবেশ করলে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বস্তুত ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহী পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে পুরো সেক্টর এলাকা মুক্ত হয়। ১৭ ডিসেম্বর সকালে শহরের বিভিন্ন এলাকা ও আশেপাশে মোতায়েনকৃত পাক সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। এদিন কাজী আমিরুল করিমের নেতৃত্বে মোঃ শরিফুল ইসলাম, আবু আলম, নূর এলাহী খোকনসহ রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১০ম শ্রেণীর মোট ৫ জন ছাত্র অত্র স্কুলের ছাদে বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত জাতীয় পতাকা উড়ান। পতাকাটি মাছ ধরা ছিপের লাঠিতে উড়ানো হয়েছিল। মাস্টার পাড়ার বাড়িতে অবস্থানরত প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমানকে ছাত্ররা এ সময় বাড়ি থেকে ডেকে এনে উপস্থিত করেছিলেন। পতাকাটি বানিয়েছিলেন আমিরুলের বড় বোন ফাতেমা আখতারী। এর দৈর্ঘ্য ছিল দেড় ফিট। ১৮ ডিসেম্বর খুব ভোরে পাক সেনারা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নাটোর চলে যায় এবং সেখানে বিকেলে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনারা ছেড়ে যাবার পর ১৮ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে জোহা হলে আবস্থান নেয় ও ক্যাপ্টেন গিয়াস বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বদিউজ্জামান টুনু ও নূর হামীম রিজভীকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
রাজশাহী বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি সমাবেশ ২০০৩ স্মরণিকা থেকে জানা যায়, ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহী শহর শক্রমুক্ত হলেও চাঁপাই নবাবগঞ্জের দিক থেকে ৪নং সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস ১৭ ডিসেম্বর রাজশাহী এসে পৌছান। ১৮ ডিসেম্বর শহরবাসী মাদ্রসা ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রধান করেন। উত্তরাঞ্চলে অবস্থানরত পাক সেনারা ১০ ডিসেম্বর নাটোরে সমাবেত হয়ে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।